গল্পের নাম: অভিশপ্ত গ্রাম
পর্ব ১: আগন্তুক
পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা একটি ছোট্ট গ্রাম—নাম তার “ভৌরবাড়ি”। গ্রামটা কোনো মানচিত্রে নেই। যতবার কেউ গ্রামটা খুঁজে পেতে চেয়েছে, পথ হারিয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু যারা একবার ভৌরবাড়িতে ঢুকেছে, তারা আর কখনও ফিরে আসেনি।
হঠাৎ একদিন ঢাকা থেকে একজন তরুণ সাংবাদিক, অনিক, এই রহস্যময় গ্রামের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। তার হাতে ছিল শত বছরের পুরনো একটি ডায়েরি, যেখানে লেখা ছিল—
“ভৌরবাড়ি গ্রাম অভিশপ্ত। সূর্য ডোবার পর সেখানে কিচ্ছু স্বাভাবিক থাকে না...”
অনিক এর আগেও অনেক ভৌতিক কাহিনি কভার করেছে। কিন্তু এবার সে নিজেই ঘটনাস্থলে যেতে চায়। স্থানীয়রা তাকে বারবার নিষেধ করে, “ভাইসাব, ওই জায়গায় সন্ধ্যার পরে কুকুরেরও ছায়া পড়ে না।” কিন্তু অনিকের জেদ, কৌতূহল আর সাহস তাকে থামাতে পারেনি।
গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছেই সে বুঝতে পারে, এখানে কিছু একটা ঠিক নেই। গাছগুলো যেন কাঁপছে, বাতাসে একটা পচা গন্ধ, আর পাখির আওয়াজ নেই। ঘড়িতে তখন বিকেল ৫টা ৪৫। সূর্য ডোবার আগে তাকে গ্রামে ঢুকতে হবে।
সে যখন গ্রামে ঢুকল, তখন চারদিক নিঃস্তব্ধ। হঠাৎ এক বুড়ি এসে সামনে দাঁড়াল। তার চোখে ছিল গভীর দুঃখ আর ভয়। সে ফিসফিস করে বলল, “তুই ফিরে যা... সন্ধ্যা নামার আগেই... না হলে তোকে ওরা ছাড়বে না...”
অনিক হতভম্ব হয়ে গেল। “ওরা” কারা?
সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা, কিন্তু সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিশপ্ত গ্রামে কিছু একটার জেগে ওঠা শুরু হলো...
পর্ব ২: সন্ধ্যার পর
অনিক বুড়ির কথা কানে না নিয়ে আরও ভেতরে এগিয়ে যায়। তার কাঁধে ঝুলছে ক্যামেরা, আর ব্যাগে রেকর্ডার আর নোটবুক। চারপাশে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে। সূর্য যেন এখানে একটু বেশিই তাড়াতাড়ি ডুবে যায়।
গ্রামটা যেন একটা মৃত্যুপুরী। বাড়িগুলোতে ধুলো জমে আছে, জানালাগুলো ভাঙা, ছাদে গাছগাছালি গজিয়েছে। কোথাও কোনো কুকুর নেই, না আছে একটা পাখি। বাতাস থেমে গেছে। শুধু মাঝে মাঝে ভেঙে পড়া বাঁশবাগানের মধ্যে থেকে অদ্ভুত এক ফিসফাস কানে আসছে। যেন কেউ ফিসফিস করে বলছে—“সে এসেছে... সে এসেছে...”
হঠাৎ অনিক দেখে, এক পুরোনো মন্দিরের ধারে একটা মেয়েকে বসে কাঁদতে। গায়ে লাল শাড়ি, কপালে সিঁদুর, আর চোখে জল। তার কণ্ঠে ভেসে এলো—
“আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও... আমি ওদের হাত থেকে পালাতে চাই...”
অনিক এগিয়ে গেল, “আপনি কে? এখানে কী করছেন?”
মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে একটা ভয়ানক হাসি হাসল। চোখদুটো হঠাৎ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। সে বলল, “তোকে ওরা পছন্দ করে ফেলেছে। এবার তুইও থাকবি... চিরকাল... আমার মতো...”
হঠাৎ একটা ঝড় উঠল, যেন মাটির নিচ থেকে গর্জন আসছে। অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠল, আর সেই মেয়েটি চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
অনিক হতবাক। হঠাৎ তার পেছন থেকে কে যেন ফিসফিস করে বলল—
“তুই পালাতে পারবি না... অভিশাপ শুরু হয়েছে...”
পর্ব ৩: নিষিদ্ধ পাণ্ডুলিপি
ঝড়ের শব্দ থেমে গেলেও অনিকের হৃদকম্প থামেনি। সে বুঝতে পারছে, এখানে কিছু একটা ভয়ানক লুকিয়ে আছে। তার ফোনে কোনো নেটওয়ার্ক নেই, ক্যামেরা কাজ করছে না, আর বাতাস যেন ধীরে ধীরে জমাট বাঁধা ঠাণ্ডা হয়ে উঠছে।
সে দৌড়ে একটা পুরোনো স্কুলঘরের মতো ভাঙা বাড়িতে ঢোকে। ভেতরে ধুলোমাখা বেঞ্চ, ভাঙা ব্ল্যাকবোর্ড, আর এক কোনায় একটা পুরনো আলমারি। আলমারির দরজা খুলতেই তার চোখে পড়ে একটা কাঠের বাক্স। বাক্সটা খোলার পরই সে দেখতে পায় এক পুরোনো পাণ্ডুলিপি—চামড়ার মতো কিছুতে মোড়ানো, যার গায়ে লালচে হরফে লেখা:
“অর্ঘ্য দিলে তবেই শান্তি, নাহলে জাগবে তারা, অভিশাপ বহন করবে আগন্তুক”
অনিক সেই পাণ্ডুলিপি খুলে পড়তে শুরু করে। তাতে লেখা—
“১৭৩২ সালে, ব্রাহ্মণ তান্ত্রিক ‘ভৃগুনাথ’ এই গ্রামে এক নিষিদ্ধ তন্ত্রের সাধনা শুরু করে। সে বলিদান চেয়েছিল গ্রামের সাতটি শিশুর। গ্রামবাসীরা তাকে বাধা দেয়। কিন্তু ভৃগুনাথ তার অভিশাপ দিয়ে যায়—
‘এই গ্রাম আর কখনো সূর্যোদয় দেখবে না, যারা গ্রামে পা রাখবে, তারা হবে বলি।’
তারপর থেকে, সূর্য ডোবার পর গ্রামের সব মৃত আত্মা জেগে ওঠে। তারা চায় আত্মা, তারা চায় অর্ঘ্য…”
এই পর্যন্ত পড়তেই অনিক টের পায়, তার চারপাশে কেউ যেন হাঁটছে। পাণ্ডুলিপির পাতা উল্টে যাচ্ছে নিজে থেকেই। জানালার বাইরে অন্ধকারের মধ্যে অসংখ্য জোড়া চোখ জ্বলছে—লাল, হিংস্র চোখ।
এক ফিসফিসে কণ্ঠে আবার ভেসে আসে—
“তুই পাণ্ডুলিপি খুলেছিস, তোর নাম এখন লেখা হয়ে গেছে... অর্ঘ্য শুরু হবে...”
পর্ব ৪: মুক্তির দরজা, মৃত্যু কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা
পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো এক এক করে উল্টে যাচ্ছে, যেন অদৃশ্য কারো হাতের ছোঁয়ায়। অনিক বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। বাইরের অন্ধকারে ছায়ার মতো কিছু নড়ছে—জ্যান্ত কিছু, অথচ মানুষের মতো নয়। পাণ্ডুলিপির শেষ পাতায় লেখা—
“যদি কেউ অর্ঘ্য না দেয়, তাহলে সে-ই হবে অর্ঘ্য। কিন্তু অর্ঘ্য দিলে মুক্তি মিলবে—তবে তার মূল্য চিরজীবনের পাপ। তবেই খুলবে মুক্তির দরজা।”
এবার অনিক বুঝল, সে শুধু নিজের কৌতূহল মেটাতে আসেনি—সে এসেছে ভাগ্যবিধাতা হয়ে। কারণ পাণ্ডুলিপির নিচে তার নাম আঁকা—“অনিক বসু”। সে আঁতকে উঠল। কে জানল তার নাম? কে লিখল এই লেখাগুলো বহু শতাব্দী আগে?
ঠিক সেই মুহূর্তে, বাইরে তীব্র বাতাসের মাঝে কারা যেন কাঁদতে কাঁদতে গাইছে এক বিকট মন্ত্র—“বলি চাই, বলি চাই, রক্ত চাই...”
অনিক দৌড়ে স্কুলঘর থেকে বের হয়, এক দৌড়ে চলে যায় গ্রামের মন্দিরঘরটার দিকে। বুড়ি যাকে সে আগের দিন দেখেছিল, এবার তাকে আবার দেখতে পেল। বুড়ির চোখে এখন উন্মত্ততা। সে বলল—
“তোকে সতর্ক করেছিলাম, এখন পালাবার সময় নেই। ওরা তোকে বেছে নিয়েছে... কিন্তু মুক্তির একটা পথ আছে।”
অনিক জিজ্ঞাসা করল, “কি করতে হবে আমাকে?”
বুড়ি ধীরে ধীরে বলল, “তোর জায়গায় তোর মতো আরেকজনকে দিতে পারলে তুই বাঁচবি। যাকে ওরা মনে করবে তোর আত্মা...”
“মানে? কাউকে বলি দিতে হবে?”—অনিক চিৎকার করে উঠল।
“হ্যাঁ,” বুড়ি বলল। “তুই যদি তোর জায়গায় অন্য কাউকে রেখে পালাতে পারিস, তোর আত্মা রক্ষা পাবে। কিন্তু একবার ওদের চোখে পড়ে গেলে—তুই আর মানুষ থাকবি না... তুই হবি অভিশাপের এক পুতুল...”
অনিকের মাথা ঘুরছে। হঠাৎ মনে পড়ল—তার এক সহকর্মী রুবেল তাকে ফলো করে এই এলাকায় ঢুকেছিল, কারণ সে বিশ্বাস করত অনিক একা গিয়ে সব কভারেজ নিয়ে নিচ্ছে। সে এখনো গ্রামের বাইরে কোথাও থাকবে—অনিককে অনুসরণ করতে করতে আসবে এই গ্রামে।
এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিকল্প ১: রুবেলকে ডেকে এনে তার জীবন দিয়ে নিজের জীবন বাঁচানো।
বিকল্প ২: নিজে থেকে আত্মবলিদান দিয়ে অভিশপ্তদের মুক্ত করে গ্রামকে শান্ত করা।
এমন সময় পেছনে বিকট শব্দে মাটিতে ফাটল ধরল। সেই ভয়ঙ্কর মেয়েটি, যে প্রথম রাতে লাল শাড়িতে কাঁদছিল, সে আবার হাজির—
“সময় শেষ হচ্ছে অনিক। ওরা উঠে আসছে মাটির নিচ থেকে... তুই কাকে বেছে নিবি?”
অনিক এবার ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল। তার মাথায় এখন একটাই প্রশ্ন—
মানুষ কি নিজের প্রাণ বাঁচাতে পারে অন্য কারো মৃত্যুর বিনিময়ে?
না কি, প্রকৃত সাহসিকতা হলো—নিজেকে উৎসর্গ করা, অন্যের জীবন রক্ষায়?
মন্দিরের গম্ভীর ঘন্টার শব্দ ভেসে আসছে…
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখন…
ঘড়ির কাঁটা থেমে যাচ্ছে…
আর অভিশপ্ত আত্মারা অপেক্ষায়…
পর্ব ৫: আত্মা ও প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা
মন্দিরের চারপাশে বাতাস থমকে গেছে। শব্দহীন আকাশ, আর নিস্তব্ধ কবরের মতো চারদিক। কিন্তু অনিকের ভেতরে চলেছে ভয়ংকর এক যুদ্ধ—মানবিকতার বিপরীতে নিজেকে বাঁচানোর লড়াই।
সে ধীরে ধীরে মন্দিরের গা ঘেঁষে বসে পড়ে। ভাঙা প্রস্তরের গায়ে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ভাবে—
“রুবেল তো কিছুই জানে না। সে তো আমাকে অনুসরণ করতে করতে কৌতূহলে আসবে। আমি যদি তাকে সামনে এনে ফেলি, ওরা বুঝবে না আমি কে। আমার রক্ষা হবে।”
ঠিক তখনই, অন্ধকারের মধ্যে এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে এলো। সেই পুরনো বুড়ি, এবার তার শরীর ভেঙে যাচ্ছে, চোখ উপড়ে পড়ে যাচ্ছে প্রায়। সে ফিসফিস করে বলল—
“তোকে ভাবা হইছে বুদ্ধিমান... কিন্তু ভুল করছিস... অভিশাপকে কেউ ফাঁকি দিতে পারে না।”
অনিক হতভম্ব। “মানে?” সে জিজ্ঞেস করল।
বুড়ি হেসে উঠল এক বিষাক্ত কণ্ঠে—“যাকে তুই বলি দিবি, তার রক্তে তোর হাত রাঙবে। ওরা রক্তের গন্ধ চেনে, পাপের গন্ধ বোঝে। আত্মা যদি অপরাধ জানে, তবেই তারা মুক্তি দেয়। তুই যদি রুবেলকে বলি দিস, তোর আত্মা চিরতরে তাদের মালিকানায় চলে যাবে। কারণ তুই নিজেই বিশ্বাসঘাতক হবে।”
অনিক বোবা হয়ে যায়। একপাশে পাণ্ডুলিপির শেষ শব্দ বারবার তার মনে বাজতে থাকে—
“মুক্তি শুধু আত্মদানের ভেতরেই সম্ভব। আত্মবাঁচানোর লোভই অভিশাপের মূল।”
ঠিক তখন, দূরে রুবেলের কণ্ঠ শোনা গেল—“অনিক ভাই? আপনি আছেন? আমি আপনাকে খুঁজছিলাম!”
সে টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে আসছে। অনিক দৌড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“তুই এখানে এলি কেন?” অনিক চিৎকার করে উঠল।
“আপনার কাহিনি চুরি করতে আসিনি ভাই,” রুবেল বলল। “আমি ভয় পেয়েছিলাম... আপনি বহুক্ষণ ধরে সাড়া দিচ্ছিলেন না... তাই আসলাম।”
হঠাৎ মাটির নিচ থেকে গর্জন শুরু হলো। রক্তরাঙা এক হাত মাটির নিচ থেকে উঠে এলো, আরেকটা ছায়া পেছন থেকে রুবেলের দিকে এগিয়ে এল। রুবেল চিৎকার করে উঠল—“এ কী ভাই! কী হচ্ছে?”
অনিক দাঁড়িয়ে রইল। একদিকে আত্মরক্ষা, অন্যদিকে বন্ধুত্ব, বিশ্বাস... সত্য।
ঠিক সেই মুহূর্তে, অনিক সিদ্ধান্ত নিল।
সে নিজের হাতে থাকা সেই পাণ্ডুলিপি আগুনে ছুঁড়ে দিল। তারপর মন্দিরের কেন্দ্রে গিয়ে চিৎকার করে বলল—
“ওরা তো শুধু বলি চায়, তাই না? তবে নাও, আমি আসছি... কিন্তু আমার আত্মাকে ছেড়ে দাও। এই অভিশপ্ত চক্র শেষ হোক।”
রুবেল হা করে তাকিয়ে রইল।
অনিক চোখ বন্ধ করল। ঠিক সেই সময় শত শত ছায়ামূর্তি চারদিক থেকে মন্দিরের মধ্যে এসে ঢুকল—তারা অনিককে ঘিরে ধরল, তার শরীর টেনে নিয়ে গেল নিচে, মাটির গভীরে, এক অন্ধকার গুহায়... যেখানে শতাব্দী ধরে বন্দি অসংখ্য আত্মা চিৎকার করে কাঁদছে।
কিন্তু আশ্চর্যভাবে, এক মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু থেমে গেল।
গ্রামে সূর্যের আলো পড়ল প্রথমবারের মতো। পাখিরা ডাকতে শুরু করল। বাতাসে এক তাজা গন্ধ।
রুবেল তখনও স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে। মাটির ফাটল ভরে যাচ্ছে। মন্দির ধীরে ধীরে গুঁড়িয়ে পড়ছে। আর ভৌরবাড়ির গ্রামের চারপাশে শোনা গেল এক নিঃশ্বাসের শব্দ—
“ধন্যবাদ… মুক্তি পেয়েছি… কিন্তু প্রতিশোধ এখনও বাকি…”
পর্ব ৬: মৃত নয়, বদলে যাওয়া
রুবেল থমকে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে সব কিছু বদলে গেছে—সকাল হয়েছে, সূর্যের আলো পড়েছে, পাখিরা ডাকছে, বাতাসে জীবনের স্পর্শ। অথচ রুবেলের হৃদয়ে একটাই প্রশ্ন বাজছে বারবার—
“অনিক কোথায়?”
গ্রামের ভাঙা মন্দির এখন পুরোপুরি ধসে পড়েছে। তার নিচে শুধু ধ্বংসস্তূপ। পাণ্ডুলিপি, ছায়ামূর্তিরা, অভিশপ্ত আওয়াজ—সব যেন অদৃশ্য। কিন্তু বাতাসে এখনো এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা অনুভূতি।
রুবেল পেছনে ঘুরতেই দেখে, একজন দাঁড়িয়ে আছে। সাদা শার্ট, গলায় ক্যামেরা, চোখে ভয়ংকর এক স্থিরতা।
“অনিক ভাই!”—রুবেল আনন্দে ছুটে যায়।
কিন্তু সেই অনিক কিছুই বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে। তার চোখে আগের উষ্ণতা নেই—সেখানে যেন শুধুই শূন্যতা।
রুবেল বলল, “আপনি বাঁচলেন কীভাবে? এত কিছু ঘটলো, আমি ভেবেছিলাম আপনি... আপনি তো মাটির নিচে চলে গিয়েছিলেন...!”
অনিক ধীরে ধীরে মুখ তুলল। তারপর গলা খাঁকিয়ে বলল—
“সবাই ভাবে আমি মরেছি... কিন্তু আমি বদলে গেছি। আমি এখন... ওদের এক অংশ।”
রুবেল হতভম্ব। “কি... কী বলছেন আপনি?”
অনিকের চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। সে বলল,
“তুই কি জানিস, তোর জন্য আমি শেষ মুহূর্তে নিজের জীবন দিলাম? ওরা আমাকে এক বিকল্প দিল—তোর প্রাণ অথবা আমার আত্মা। আমি তোর প্রাণ বাঁচালাম। কিন্তু... মুক্তি পেলেও, আমি এখন ওদের সঙ্গে বাঁধা। আমি মরিনি, আমি এখন এক জীবন্ত অভিশাপ।”
হঠাৎ করেই বাতাস ভারি হয়ে উঠল। চারপাশে ছায়ামূর্তির আভাস ফের দেখা যেতে লাগল।
অনিক ফিসফিস করে বলল—
“ওরা চায় প্রতিশোধ... যারা প্রথম সেই তান্ত্রিককে হত্যা করেছিল, তাদের বংশধররা আজও বেঁচে আছে। তুই জানিস, তুই তেমনই একজন?”
রুবেল পেছনে এক পা পিছিয়ে যায়। “আমি...? না না... আমি তো কিছু জানি না...”
“তোর রক্তে আছে সেই ইতিহাস। তোরা ছিলি যারা বাধা দিয়েছিল সেই কালরাত্রির তন্ত্রসাধনায়। এখন ওরা চায় প্রতিশোধ। আর আমি... আমি এখন সেই বাহক।”
হঠাৎ করেই অনিকের দেহে কালো ধোঁয়া জড়িয়ে উঠল। তার শরীর থেকে যেন জ্বলে ওঠা ছায়ারা বেরিয়ে আসছে।
সে আরও কাছে এসে ফিসফিস করল—
“তুই পালা, যতদূর পারিস। কারণ অভিশাপ তোকে ছাড়বে না। আর আমিও না... কারণ আমার মধ্যে এখন অনিক নেই... আছে এক শতাব্দী পুরনো প্রতিশোধ।”
হঠাৎ এক বিকট চিৎকারে চারদিক কাঁপতে লাগল। রুবেল দৌড়ে পালাতে শুরু করল, আর পেছনে ছায়ার মতো ধাওয়া করতে লাগল তার একসময়ের প্রিয় বন্ধু, এখনকার বিভীষিকা—অনিক।
পর্ব ৭: শিকারের জন্ম, শিকারির উত্থান
রুবেল দৌড়ে পালাচ্ছে। অন্ধকার, আবার সেই পুরনো অন্ধকার, যেটা ফিরে এসেছে দিনের আলোয়। পেছনে অনিকের পদচিহ্ন নেই, কিন্তু ছায়া আছে। চারদিক ঘিরে আসছে ছায়ামূর্তিরা, বাতাসে যেন কারা হেসে উঠছে—ভয়ংকর নিঃশ্বাসে।
রুবেল দম ফেলতে পারছে না। তার চোখে শুধু আতঙ্ক, বুকের ভিতরে দাউ দাউ আগুন। একটা সময় সে পড়ে গেল। সামনে এক গাছ, গাছের গায়ে খোদাই করা এক নাম—“ভৌর রাজবাড়ি”।
সে আশ্চর্য হয়ে ভাবল—“ভৌর রাজবাড়ি তো সেই তান্ত্রিকের স্থান ছিল, যার হত্যার পর অভিশাপ শুরু হয়। আমি এখানে কেন?”
গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল একটি প্রাচীন ইটের পথ, যা চলে গেছে ঘন জঙ্গলের ভিতরে। রুবেল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করল। হয়তো এখানেই তার উত্তর আছে, হয়তো এখানেই তার মুক্তি।
পেছনে ধেয়ে আসছে মৃত্যু, সামনে লুকিয়ে আছে অতীত।
রুবেল সাহস করে ভেতরে ঢোকে। ঘন গাছপালার মাঝে হঠাৎই বেরিয়ে আসে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজপ্রাসাদ। দরজা বন্ধ। কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ—রক্তমাখা কাপড়ে, হাতে একটি লাঠি, চোখে চেনা চেহারা।
“তুমি এসেছো শেষ উত্তর পেতে,” বৃদ্ধ বলল।
“কে আপনি?”—রুবেল কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে।
“আমি শেষ রক্ষক। আমি জানি তোর জন্ম কোথা থেকে, তোর বংশধারা কোথায় জড়িয়ে আছে। তুই সেই পরিবারের উত্তরসূরি, যারা ভৌর তান্ত্রিককে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল। অভিশাপ সেই থেকে শুরু। আর অনিক... সে এখন প্রতিশোধের বাহক।”
রুবেল থমকে গেল। “তবে কী আমি... আমি দায়ী?”
“তুই দায়ী না,” বৃদ্ধ বলল। “তোর পূর্বপুরুষদের পাপ তোর রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে। আর তাই ওরা তোর রক্ত চায়। কিন্তু তুই পালাতে পারিস, যদি সাহস থাকে। ওদের অভিশাপ কাটাতে চাই একজন শিকার... এক আত্মা, যে পাপমুক্ত। তুই যদি তোর আত্মা শুদ্ধ করতে পারিস, তুই পারবি অভিশাপ শেষ করতে।”
“কিন্তু কিভাবে?”—রুবেল প্রশ্ন করল।
“তোর হাতে আছে সময় মাত্র তিন রাত। এর মধ্যে তুই যদি ‘তপোবনে’র পুরনো সাদা পাথরের নীচ থেকে সেই তান্ত্রিকের ছাই তুলে আনতে পারিস, আর ‘তিনচূড়া পাহাড়ের’ উপরে গিয়ে ওই ছাই ছড়িয়ে দিতে পারিস, তবেই অনিক ও অন্য আত্মারা মুক্তি পাবে। নইলে… তুইও হয়ে যাবি অভিশপ্তদের একজন।”
বৃদ্ধ হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আর তখনই পেছন থেকে ভেসে এল অনিকের ভয়ানক কণ্ঠস্বর—
“তিন রাত? তার একটাও লাগবে না... আমি এখনই তোর রক্ত চাই...”
বাতাসে শোনা গেল ঝড়ের গর্জন। গাছের পাতাগুলো ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে। আর রুবেল দাঁড়িয়ে, কাঁপা কাঁপা হাতে মুঠো করছে তার শেষ সাহস...
পর্ব ৮: তিন রাতের প্রথম রাত – ছায়ার ধ্বনি
রুবেল রাজবাড়ির সামনের গাছের নিচে বসে আছে। সূর্য ডুবে গেছে। চারদিকে আবার সেই অচেনা নীরবতা। প্রথম রাত শুরু হয়েছে। আর এই রাতই হবে তার প্রথম পরীক্ষা।
তার হাতে একটা ছোট ব্যাগ—বৃদ্ধ রেখে গিয়েছিল। ভিতরে শুধু একটি লাল সুতো, একটি রূপার কয়েন, আর একটি পাতলা মানচিত্র। সেই মানচিত্রেই লেখা আছে “তপোবন – পূর্ব জঙ্গলের ভিতরে মৃত সাদা গাছ”।
রুবেল এগিয়ে যায়।
পথে অন্ধকার জঙ্গল ঘিরে ধরেছে তাকে। তার কানে যেন কারা ফিসফিস করে ডাকছে—“ফিরে যা... ফিরে যা...”
কিন্তু সে জানে, ফিরলে সে বাঁচবে না। সামনে যেতে পারলেই হয়তো মুক্তি।
হঠাৎ সে দেখতে পেল দূরে একটা সাদা রঙের গাছ। গাছটার গায়ে কোনো পাতা নেই, ডালগুলো যেন মানুষের হাতের মতো ছড়ানো। গাছের নিচে মাটি একটু উঁচু, যেন কেউ কবর দিয়েছে।
রুবেল ধীরে ধীরে গর্ত খুঁড়তে শুরু করে।
মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে এলো এক অদ্ভুত ধাতব পাত্র, তার ভিতরে কালচে ছাই আর একটা ছায়ার মুখ।
ছায়ার মুখটা হঠাৎ চোখ খুলে ফিসফিস করে বলল—
“তুই যদি আমাকে নিয়ে যাস, আমি তোর ভিতরে ঢুকে যাব...”
রুবেল কাঁপতে থাকে। কিন্তু সে জানে, ভয় পেলে চলবে না। সে রূপার কয়েনটা ছায়ার মুখের উপর রাখে—ছায়াটা ছটফট করে, আর পাত্র আবার নিঃশব্দ হয়ে পড়ে।
ছাই সে তুলে নিল ব্যাগে।
ঠিক তখনই জঙ্গলের পেছনে শুনতে পেল চেনা পায়ের শব্দ—তবুও অচেনা।
অনিক।
রুবেল দৌড়াতে থাকে। জঙ্গলের গা ঘেঁষে ছোটে, পেছনে ছায়ার মতো ধেয়ে আসে অনিক। কিন্তু এবার অনিকের মুখে মানুষ নয়, যেন এক পশুর আক্রোশ। সে হিংস্র হয়ে ফিসফিস করে—
“তুই ওকে ছুঁয়েছিস? ও আমার প্রভু। তোর দুঃসাহস কেমন করে হল?”
রুবেল বলল—“তুই এখন অনিক না। তুই একজন বন্দি আত্মা। আমি তোকে মুক্তি দিতে চাই!”
অনিক চিৎকার করে উঠল—
“মুক্তি? আমায় বন্ধন দিয়েছে তুইই। বন্ধন ছাড়াতে হলে তোকেই পোড়াতে হবে...”
ঠিক সেই সময় আকাশে বজ্রপাত হল। পাথর ভেঙে পড়ল। একটা গাছ হুমড়ি খেয়ে পড়ল অনিকের দিকে—সে অল্পের জন্য সরে গেল, কিন্তু গর্জে উঠল ভয়ানকভাবে।
রুবেল সেই সুযোগে ছুটে পালাল।
ছুটতে ছুটতে পৌঁছালো একটা পুরনো শিব মন্দিরে। বৃদ্ধ যেটা মানচিত্রে চিহ্ন দিয়ে বলেছিল—“এই মন্দিরেই প্রথম রাতের আশ্রয়। এখানেই তোর আত্মা পবিত্র হবে।”
রুবেল ভেতরে ঢুকে দেখে শিবলিঙ্গের নিচে পাথরে লেখা—
“প্রথম রাত শেষ, যদি আগুন জ্বালাতে পারিস।”
তার কাছে আগুন নেই। সে মাথায় হাত দিল—হঠাৎ তার ব্যাগে রাখা পাত্র থেকে উষ্ণতা ছড়াতে লাগল। ছাইয়ের পাত্র হালকা আলো দিতে শুরু করল। সে পাথরের গায়ে ছাই মাখাল—আর মুহূর্তেই মন্দিরজুড়ে জ্বলে উঠল অগ্নিশিখা।
মন্দির আলোয় ভরে উঠল।
বাতাসে ভেসে এল সেই বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর—
“প্রথম রাত শেষ... দ্বিতীয় রাত আরও কঠিন... কারণ ছায়ারা এবার তোর ভিতরেই আসবে...”
রুবেল গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। মাটি যেন শক্ত—not প্রাকৃতিকভাবে, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ চাপা দিয়েছে। হঠাৎই কোদাল ঠেকে গেল কিছু একটার গায়ে। সে মাটি সরিয়ে দেখে—একটা পুরনো, পাথরের পাত্র। ঢাকনা শক্তভাবে বন্ধ।
সে পাত্রটা তুলতেই চারপাশে বাতাস যেন এক মুহূর্তে থেমে গেল। গাছের পাতা হাওয়ায় কাঁপা বন্ধ করে দিল। রুবেল কাঁপা হাতে ঢাকনা খুলল—
ভেতরে ধূসর ছাই, আর একটা পোড়া চামড়ার টুকরো—যেখানে তান্ত্রিকের নাম লেখা, 'ভৌরনাথ'।
সে বুঝে গেল—এই সেই ছাই, যেটা নিয়ে তাকে যেতে হবে তিনচূড়া পাহাড়ের চূড়ায়।
কিন্তু ঠিক তখনই মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এলো একটা হাত! রক্তাক্ত, পোড়া, ছেঁড়া চামড়ার হাত। রুবেল আঁতকে উঠে পেছনে সরে যায়।
পেছন থেকে সেই ভয়ানক চেনা কণ্ঠ ভেসে আসে—
“তুই অনেকদূর এসেছিস... কিন্তু এখনো শেষ নয়। আমি তোকে ত্যাগ করব না...”
অনিক—কিন্তু এ অনিক পুরোপুরি মানুষ না। তার মুখের অর্ধেক জ্বলন্ত, চোখ থেকে অশ্রু নয়, আগুন গড়িয়ে পড়ছে।
“এই ছাই যদি ছড়িয়ে পড়েও, মুক্তি পাবে না তুই! কারণ তোর মধ্যে ভয় আছে... ভয়ই আমাদের শক্তি...”
রুবেল ছুটে পালাতে শুরু করে। কিন্তু পেছনে ছায়ারা দৌড়াচ্ছে। চারদিক থেকে আওয়াজ হচ্ছে—
“পাপের বংশধর... পাপের বংশধর...!”
হঠাৎ, রুবেল পিছলে পড়ে যায়। তার হাত থেকে ছাইয়ের পাত্র ছিটকে যায়... আর সামনে দাঁড়িয়ে যায় একজন চেনা মুখ—বৃদ্ধ রক্ষক।
তিনি বললেন,
“তোর প্রথম রাত শেষ হতে চলেছে। কিন্তু মনে রাখ, ছাই তো সংগ্রহ করলি—এখন চাই বলি। দ্বিতীয় রাত হচ্ছে আত্মত্যাগের রাত।”
রুবেল হতবাক, “বলি? কিন্তু আমি তো কাউকে মারতে পারি না!”
“না,” বৃদ্ধ বললেন, “এই বলি রক্তের নয়, আত্মার। তুই নিজের সবচেয়ে প্রিয় কিছু ত্যাগ করতে পারলে তবেই দ্বিতীয় রাত কাটবে। নইলে, তোর আত্মা ছিঁড়ে খাবে অনিক... আর সে হবে পূর্ণ শক্তির অভিশপ্ত আত্মা।”
পেছনে তাকাতেই দেখে অনিক অদৃশ্য হয়ে গেছে। কেবল বাতাসে তার ভয়ংকর হাসির প্রতিধ্বনি—
“দ্বিতীয় রাতেই দেখা হবে... প্রিয় বন্ধুর জন্য তুই কতটা কাঁদতে পারিস, দেখব!”
রুবেল ধীরে ধীরে ব্যাগে ছাই ভরে নেয়। চারপাশে রাতের নীরবতা ঘন হয়ে আসে।
পর্ব ৯: দ্বিতীয় রাত – আত্মত্যাগের আগুন
রুবেল এখন সেই পুরনো শিবমন্দিরে। চারপাশ নিস্তব্ধ। প্রথম রাত শেষ হলেও তার মুখে শান্তি নেই। বৃদ্ধ বলেছিল দ্বিতীয় রাত হল আত্মত্যাগের রাত—আর সেই বলি দিতে হবে নিজের সবচেয়ে প্রিয় কিছু ত্যাগ করে।
রুবেল কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে?
সে ভাবতে বসে—তার ছোট বোন রিমি, যাকে সে আগুনে পুড়ে মরতে দেখেছিল… তার মা, যিনি অভিশপ্ত আত্মার ভয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন… এবং সবচেয়ে বড় কথা, অনিক—তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, যাকে সে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসত।
“অনিক… তুই যদি সত্যিই এই অবস্থায় না পড়তিস, তবে তুইই আমাকে বাঁচাতে সামনে দাঁড়াতি,” রুবেল বলল।
ঠিক তখনই মন্দিরের ছাদ কেঁপে উঠল। ধোঁয়া-মাখানো বাতাস ছড়িয়ে পড়তে লাগল ভিতরে। ছায়ার দল প্রবেশ করল কুয়াশার মতো। আর সেই কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল অনিক—কিন্তু এবার সম্পূর্ণ অন্য রূপে।
তার শরীরের অর্ধেকটা এখন ছাইয়ে রূপান্তরিত, মুখের একপাশে জ্বলন্ত রক্তগঙ্গা, হাতে একটা পোড়া কাঁসার থালা—ভেতরে তাজা রক্তের মতো তরল কিছুর প্রতিচ্ছবি।
“আজ তুই ত্যাগ করবি। না করলে, আমি করব…”
রুবেল ভয়ে পেছিয়ে যায়। অনিক এগিয়ে আসে।
“তুই জানিস, তুই কাকে ভালোবাসিস সবচেয়ে বেশি?”
“নিজেকে। নিজের ভিতরের ভয়, নিজের অতীত, নিজের ভুল—সেইসব ধরে রেখেই তুই এখনো বাঁচতে চাইছিস।”
অনিক হঠাৎ থালা ছুড়ে মারে রুবেলের দিকে। ঠিক তখনই কাঁপতে কাঁপতে রুবেল পড়ে যায় শিবলিঙ্গের পাদদেশে।
একটি আলোর রেখা জ্বলে ওঠে সেখানে—আর বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর শোনা যায়—
“বল, কী ত্যাগ করবি?”
রুবেল চিৎকার করে উঠে বলল—
“আমি আমার দোষ স্বীকার করছি। আমি আমার আত্মগর্ব, ভয়, আর সেই বন্ধুত্ব, যা আমি রক্ষা করতে পারিনি—সেই অনিককে আমি আজ মুক্তি দিতে চাই। আমি নিজেকে ত্যাগ করতে রাজি।”
বাতাস স্তব্ধ হয়ে গেল। ধোঁয়া হঠাৎ হালকা হতে লাগল।
অনিক থেমে গেল।
তার চোখে যেন এক ফোঁটা অশ্রু।
“তুই... সত্যিই তোর অন্তর খুলেছিস?”
রুবেল চিৎকার করে বলল—
“তুই আমার বন্ধু, অনিক। আমি তোকে হারাতে চাই না। কিন্তু যদি তোর আত্মা মুক্তি চায়, তবে আমি প্রস্তুত।”
অনিক ধীরে ধীরে পেছনে হেঁটে গেল। তার শরীরের ছাইভাগ গলে যেতে লাগল বাতাসে। এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এল মন্দিরজুড়ে।
আর সেই মুহূর্তে আকাশে বাজ পড়ল। কণ্ঠ ভেসে এল—
“দ্বিতীয় রাত শেষ। বলি গৃহীত হয়েছে। কিন্তু সামনে শেষ রাত—তিনচূড়া পাহাড়ের রাত, যেখানে মুছে যাবে সব...”
রুবেল হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়াল। চোখে জল, কিন্তু এক অদ্ভুত শক্তি।
আগামী রাত, শেষ রাত—অভিশপ্ত গ্রাম মুক্তি পাবে কিনা, নির্ভর করছে শুধু তার উপর।
পর্ব ১০: তৃতীয় রাত – তিনচূড়া পাহাড়ের শেষ যাত্রা
রুবেল আর এক মুহূর্তও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। দ্বিতীয় রাতের অভিজ্ঞতা তার ভিতর গভীর এক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। আজ রাতে শেষ হতে চলেছে তার যাত্রা—তিনচূড়া পাহাড়ের চূড়া। বৃদ্ধ বলেছিল, এখানে শেষ হবে অভিশাপ, শেষ হবে তান্ত্রিক ভৌরনাথের শক্তি।
সে কাঁপতে কাঁপতে পাহাড়ের দিকে পা বাড়ায়।
পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছতেই একটা অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হতে থাকে। চারপাশে ঘন কুয়াশা, বাতাসে তীব্র শীতলতা। কিছুক্ষণ হাঁটার পর, হঠাৎ চোখে পড়ল পাহাড়ের চূড়ায় আগুনের আলো। মন্দিরের মতো কিছু একটা দৃশ্যমান হচ্ছিল—তবে সেটা ছিল এক রকমের অলৌকিক স্থান, যেখানে মানুষের পা পড়লে মনে হয় পৃথিবীর সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই।
রুবেল যেন তার আত্মাকে হারিয়ে ফেলেছে, তবে তার মন এক জায়গায় স্থির—এই রাতই শেষ, তাকে নিজের সকল ভয় কাটিয়ে উঠতে হবে।
শ্রোতাদের মধ্যে এক ভয়ানক গর্জন শোনা গেল—“এটা শেষ রাত, তোর সকল আত্মত্যাগ, তোর সকল চেষ্টা ব্যর্থ হবে, কারণ তুই ভয় পাবে!”
রুবেল চোখ খুলে দেখে—অনিক। কিন্তু এবার সে পুরোপুরি এক ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। তার চোখের পাপড়ি নেই, মুখটা বিকৃত হয়ে গিয়েছে, যেন অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে। তার শরীরের গায়ে ছাই লেগে আছে, আর অদ্ভুত এক আলো ছড়াচ্ছে।
“তুই ভাবিস তুই আমাকে হারাতে পারবি? তুই যে ভয়কে আঁকড়ে ধরেছিস, সে তোরই অংশ!”
রুবেল আর দেরি না করে তার পকেট থেকে ছাইয়ের পাত্র বের করে ফেলল। ভয়ে তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু মনে মনে সে জানত—এটাই তার শেষ সুযোগ।
সে ছাইয়ের পাত্রটা উন্মুক্ত করে দিল—আর তা মন্দিরের পাথরে ছড়িয়ে দিল। কণ্ঠের আওয়াজ স্নিগ্ধ হয়ে এল, যেন হাজার বছর আগের তান্ত্রিকের ভস্ম থেকে উঠে আসছে এক ভয়ঙ্কর শক্তি।
“তুই কী করে এতটা সাহস পেয়েছিস, রুবেল?” অনিক এগিয়ে আসতে লাগল, কিন্তু তার শরীর কাঁপছিল। ছাইয়ের স্পর্শে তার দেহ সরে গিয়ে এক অদ্ভুত অশ্রাব্য সুর গাইছিল। “তোর সাহস তো আমাকে দেখাতে হবে, কিন্তু তোর ভয় আমাকে ছুঁতে পারবে না।”
রুবেল চিৎকার করে বলল—
“তুই আমার বন্ধু ছিলিস! তুই এখন হয়ে গেছিস এক অন্ধকারের ছায়া, যা আমি কাটিয়ে দেব!”
আকাশে বজ্রপাত হল, পৃথিবী কেঁপে উঠল। তখনই ভৌরনাথের প্রাচীন চূড়া থেকে এক অদ্ভুত শক্তি ছড়িয়ে পড়ল। রুবেল দেখল, ছাইয়ের মধ্যে এক ভয়ানক মুখ উঠে আসছে—তার শরীর থেকে অন্ধকার তরঙ্গ বের হয়ে আসছে।
এটাই শেষ সময়। রুবেল যদি আজ অনিককে মুক্তি দিতে না পারে, তাহলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।
সেই মুহূর্তে, রুবেল নিজের ভেতরের এক অজানা শক্তি অনুভব করল। তার মনের সব ভয়, সব আতঙ্ক, সব শঙ্কা মুছে গিয়ে গগনচুম্বী এক দৃঢ়তা তার মধ্যে জেগে উঠল।
সে অনিকের দিকে চেয়ে বলল—
“আমার দিক থেকে ভয় পাবে না তুই! আজ আমি তোর মনের ভিতর ঢুকে যাব!”
রুবেল তান্ত্রিক ছাইয়ের শেষ টুকরো তার হাতে চেপে ধরল, আর অনিকের দিকে এগিয়ে গেল। পাথরের উপর ছড়িয়ে দেওয়া ছাই গাঢ় হয়ে উঠল—এক ভয়ংকর চিত্রের সৃষ্টি হল। সে জানত—এটা আর কোনো যুদ্ধ নয়, এটা এক আত্মসমর্পণ।
আকাশে ছড়িয়ে পড়ল এক আলোর ঝিলিক, আর অনিক হু হু করে আকাশে মিলিয়ে গেল।
রুবেল চোখ বন্ধ করল, আর সারা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল।
চলবে...
Post a Comment