অধ্যায় ৬:
দুঃস্বপ্নের গভীরে রাতের অন্ধকার কুড়ে কুড়ে এসে আছড়ে পড়েছিল ঘরের জানালায়। বাতির আলো ঘরটিকে অস্বস্তিকর একটা ছায়ায় ঢেকে রেখেছিল, যেন কিছু অদৃশ্য মুখ চোখে পড়বে। রাফি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে থাকলেও, মাথার ভেতর দানা বাঁধছিল অনেকগুলো প্রশ্ন। আগুনের প্রতি তার অদ্ভুত টান, সেই প্রতারণা, আর মায়ের অবিশ্বাস্য মৃত্যু—এসব যেন তাকে আরও বেশি করে তাড়িত করছিল। তবে আজ রাতে সে এক অদ্ভুত অনুভূতির মুখোমুখি হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, সে যেন এক অন্ধকার জগতে ঢুকে পড়েছে, যেখানে সমস্ত সত্যের থেকে আরও গভীর কিছু তাকে অনুসরণ করছে। তার মধ্যে কি কোনো অজানা শক্তি বাসা বেঁধেছে? “রাফি, তোর ভিতরের আগুন আর সহ্য করা যাবে না। যদি তুই আমাদের রক্ষা করতে চাস, তোকে নিজের ভিতরের অন্ধকারকে জয় করতে হবে,” মায়ের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি তার মাথার ভেতর আরও গভীরে প্রবাহিত হচ্ছিল। রাফি চোখ খুলে তাকাল। জানালার বাইরে তার অশুভ কোনো প্রতিচ্ছবি দেখা দিল কি না, সে দিকেও মনোযোগ দিল। কিন্তু কিছুই ছিল না। তবুও, এই নিস্তব্ধতার মধ্যে কিছু একটা ক্ষত-বিক্ষত করতে চাইছিল তার সত্তা। রাফির সামনে পুরানো এক ছবি ভেসে উঠলো—মায়ের আগুনে পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য। সে দুঃস্বপ্নের মতো বারবার দেখতে পাচ্ছিল। আগুনের লাল আভা, মায়ের যন্ত্রণা, আর শেষতক তার মায়ের চলে যাওয়ার দৃশ্য। তার মনে হচ্ছিল, সেই আগুনই তাকে ডাকছে। মায়ের মৃত্যুর পেছনে কি সেই আগুনের ছেলে দায়ী? কি এমন ভিশন ছিল তার মধ্যে যা জানিয়ে দিচ্ছিল যে, রাফিকে সে থামাতে চায় না, বরং আরো এগিয়ে যেতে বলছে! “তুই যদি আমার দিকে আসিস, তোর জীবন পুরোপুরি বদলে যাবে। কিন্তু সেই পথ চলতে তোর সত্যিকারের সাহস চাই,” একটি রহস্যময় কণ্ঠ তার কানে এলো। রাফির পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। এক মুহূর্তে, সে সিদ্ধান্ত নিল—সে এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবে। সত্য কী, সেটা জানার জন্য তাকে আরো এগিয়ে যেতে হবে। আগুনের ছেলে, কে সে? কেন তার প্রতি এতো টান? তার উত্তর খুঁজতে সে আরও গভীরে নামবে। “আমি প্রস্তুত,” সে স্থির কণ্ঠে বলল, আর নিজের চোখে দৃঢ়তার চিহ্ন ফুটিয়ে তুলল। রাত্রির আঁধার যেন তাকে আরো একবার পরীক্ষা নিচ্ছিল।
রাফি বিছানায় বসে আরও কিছু সময় চুপচাপ ভাবতে লাগল। তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রতীক্ষা অনুভূত হচ্ছিল, যেন কিছু একটা তার কাছ থেকে একেবারে দূরে চলে যাচ্ছে। সে জানত, আজকের পর থেকে তার জীবন আর আগের মতো হবে না। আগুনের ছায়া তার পেছনে ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছে, আর রাফি বুঝতে পারছিল, একমাত্র তাকে নয়, পুরো শহরকেই সেই ছায়া ঘিরে ফেলতে চায়।
তার মধ্যে এক অজানা শক্তির উপলব্ধি হচ্ছিল, যেন কোনো অন্ধকার প্রাচীর তার চারপাশে ঘিরে ফেলেছে, আর সেই প্রাচীরের ভেতর কোনো সুর মিলছে। মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। তার মায়ের শেষ মুহূর্তগুলোতে যে অগ্নিকান্ড হয়েছিল, সেটি কেবল একটি দুর্ঘটনা ছিল না, এটা ছিল কিছু গভীর রহস্যের অংশ।
রাফি বিছানায় হালকা শ্বাস নিতে লাগল। সে জানত, যদি সে এই অন্ধকারের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যেতে চায়, তাকে প্রথমে সেই রহস্যগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। আগুনের ছেলে—তার মা মৃত্যুর সময় যাকে একবার ডেকেছিল—সে কী সত্যিই তাকে দেখেছিল, নাকি কোনো বিভ্রম ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, রাফি জানত, তাকে নিজের ভয়কে অতিক্রম করতে হবে।
তারপর হঠাৎ, ঘরের কোণে এক অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল। সেটা যেন কিছু না কিছু ভারী কিছু ঢাকার আওয়াজ ছিল, অথবা কিছু একটা আছড়ে পড়ার শব্দ। রাফি পেছনে ফিরে তাকাল, কিন্তু কিছুই ছিল না। তবে, তার অন্তরে একটা অস্বস্তি তৈরি হল। "এটা কি কিছু অতিপ্রাকৃত শক্তি?"—সে ভেবে উঠে দাঁড়াল।
বাইরে একটা হালকা ঝড় বইছিল, আর তার সাথে মৃদু বৃষ্টিও পড়ছিল। রাফি জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, চোখের সামনে সাদা কালো আকাশ, আর অদূরে মেঘেরা যেন কোন ভয়ের গল্প বলছে। তার মনে হলো, সে এক অদৃশ্য পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সময় থমকে গেছে।
তখনই হঠাৎ তার মাথার ভেতর এক গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে উঠল, “যদি তুই সত্যি এই পথে চলতে চাস, তোর হৃদয় থেকে আগুন বের করে আন, আর দেখ, কীভাবে তুই এই পৃথিবীকে বদলে ফেলতে পারিস।”
রাফি ভীত না হয়ে সেই কণ্ঠের প্রতি আরও আকর্ষিত হল। সে জানত, এটি হয়তো কোনো বিভ্রম বা পাগলামি নয়, বরং একটি সংকেত। যেন কেউ তাকে সামনে এগিয়ে যেতে বলছে। তবে, এটি এক ভয়ঙ্কর পথ, যার ফল হতে পারে দুর্দান্ত অথবা বিধ্বংসী।
সে ঠিক করল, আর এক মুহূর্তও দেরি না করে, সঠিক পথ খুঁজে বের করতে হবে। মায়ের মৃত্যুর রহস্য, আগুনের ছায়া, এবং সেই অদ্ভুত কণ্ঠ—সব কিছু মিলিয়ে তাকে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে।
"আমি প্রস্তুত," রাফি এক পলকও না থেমে নিজেকে বলল। তার একমাত্র উদ্দেশ্য—সে যে অগ্নির দিক থেকে সৃষ্টি হয়েছিল, সেই আগুনকে নিজে নিয়ন্ত্রণে আনবে।
রাফি তার ঘরের দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলো। রাতের অন্ধকার আরও ঘন হয়ে উঠেছিল, যেন পৃথিবী নিজেকে ছায়ার মধ্যে আড়াল করতে চাইছে। বাতাসে শীতলতা ছিল, তবে রাফির মনে তখন এক অদ্ভুত উত্তাপ অনুভূত হচ্ছিল। যেন তার শরীরের মধ্যে কোনো আগুন জ্বলছে, যা তাকে একটি নির্দিষ্ট দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
সে মনে মনে ভাবল, "এটা কি আমি সত্যিই চাই? আমি কি এতটুকু জানি আমার সামনে কী অপেক্ষা করছে?" কিন্তু তখনই তার চোখের সামনে এক টুকরো লাল আভা ফুটে উঠলো। সেই আলোটা যেন তাকে ডাকছিল। কোথাও থেকে একটি অদৃশ্য শক্তি তার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, আর তাকে সে শক্তির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
একটু সাহস পেয়ে রাফি দ্রুত রাস্তার দিকে চলে গেল। তার পায়ের নিচে মাটি ছিল, তবে তাকে মনে হচ্ছিল যেন সে কোনও অন্তহীন যাত্রার মধ্যে চলেছে, যেখানে কোনও পরিসীমা নেই। তার মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন—এই আগুনের সাথে তার সম্পর্ক কী?
একটি পুরানো শহরের কোণায় এসে দাঁড়াল রাফি। এখানে সব কিছু ছিল পুরানো, প্রায় ত্যাগ করা। ভাঙা বাড়ি, সড়ক, আর অদ্ভুতভাবে একসাথে মিশে থাকা প্রকৃতি এবং সত্তা। রাফি তার চিন্তা থেকে বের হয়ে এগিয়ে চলল, জানত সে কোনো এক গভীর রহস্যের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।
তখনই হঠাৎ, সে এক অদ্ভুত আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেল। এটি যেন মাটি থেকে উঠে আসছে, কিম্বা কেউ যেন অদৃশ্যভাবে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। রাফি ঘুরে তাকাল, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। তবে, মনে হলো তার চারপাশে কোনো কিছু চলছে, যার প্রভাব তাকে স্পর্শ করছে। যেন তার ভিতরে একটা আগুন জ্বলছে, যা তাকে একটা নিদান দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এসময়, তার কানে আবার সেই অদ্ভুত কণ্ঠ শোনা গেল। "তুমি যদি তোমার ভিতরের অগ্নিকে বের না করতে পার, তাহলে তোমার অস্তিত্ব একদম বিলীন হয়ে যাবে। এই দুনিয়ায় তোমার ভূমিকা থাকবে না।"
রাফি পুরোপুরি থমকে দাঁড়াল। এই কণ্ঠ, মায়ের মৃত্যুর আগে যেটি শুনেছিল, এখন কেন সে তাকে আবার শুনছে? কী এই সম্পর্ক, যা তাকে এমনভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে?
“আমাকে দেখ, আমি যে আগুনের মধ্যে জন্মেছি, আমাকে জান। আমি আগুনের ছেলে।” এক পুরানো পুরোহিতের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, যার হাতে ছিল একটি সোনালী তাবিজ। সেই পুরোহিত বলেছিল, "এই আগুন তোমার নিয়ন্ত্রণে আসবে, তবে তুমি যদি এটা নিজের অঙ্গীকার না করো, তবে এটি তোমার সত্তাকে গ্রাস করবে।"
রাফি শ্বাস নিয়ে নিজের মনে স্থির করল—সে মায়ের হত্যার আসল রহস্য জানবে, আগুনের ছায়া তার জীবনকে কীভাবে দখল করেছে, আর কিভাবে সে নিজেকে এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে বের করতে পারবে।
অদ্ভুতভাবে, যেন এই সিদ্ধান্তের সাথে মিলিত হয়ে, তার শরীরে নতুন এক শক্তির উপস্থিতি অনুভূত হল। মনে হচ্ছিল, তার ভিতর থেকে আগুন ফুটে বের হয়ে আসছে, আর সেই আগুন তাকে এখনই পথ দেখাবে।
তার দিকে এক অদৃশ্য শক্তি এগিয়ে আসছিল, কিন্তু এবার রাফি জানত, এই শক্তিকে তাকে ভয় পেতে হবে না। বরং, এটি তার শক্তির উৎস হতে পারে। সে নিজের ভয়কে কেটে ফেলতে সক্ষম হবে। সে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিল এবং মনে মনে বলল, "আমি আগুনের ছেলে।"
এভাবে, রাফি এক কঠিন যাত্রার পথে পা বাড়াল। এখন আর তার পিছনে ফিরে দেখার সময় নেই।
রাফি তার পথচলা শুরু করল। শহরের নির্জন রাস্তাগুলো, যেন তাকে এক নতুন গন্তব্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে, বাতাসের সাথে সঙ্গম করে, তার অন্তরে এক অদ্ভুত শক্তির উপস্থিতি অনুভূত হচ্ছিল। সে জানত, আর কোনো পথ নেই, তাকে ওই অগ্নির ছায়াকে অনুসরণ করতে হবে, সেই অগ্নির ছায়া, যেটি তার সত্তার গভীরে বিরাজমান।
যতই সে এগিয়ে চলছিল, ততই অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছিল। তার শরীরের মধ্যে আগুনের স্পর্শ স্পষ্ট হচ্ছিল—এটা ছিল সে আগুন, যা তার মা একসময় নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলেন না। তবে রাফি জানত, তাকে এই আগুনকে নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে হবে, না হলে তা তাকে পুরোপুরি গ্রাস করবে।
চলতে চলতে, রাফি এক অদ্ভুত গুহার মুখে পৌঁছাল। গুহার ভিতর থেকে এক ভয়ংকর হাওয়া বের হচ্ছিল, যা তার হৃদয়ে শঙ্কা তৈরি করছিল। এই গুহার ভেতর কী ছিল, সে জানত না, তবে তার ভিতরে এক অনুভূতি হচ্ছিল—এটাই ছিল তার পরবর্তী গন্তব্য। সে ভিতরে প্রবেশ করল।
গুহার মধ্যে প্রবেশ করার পর, কিছু সময় পরে তার চোখে অদ্ভুত লাল আভা ফুটে উঠল। যেন সে এখন কোনো অন্ধকার জগতের গভীরে প্রবেশ করেছে, যেখানে কোনো মানুষ বা জীবজন্তু ছিল না। শুধু ছিল এক রহস্যময় শক্তি, যা তাকে ঘিরে রেখেছিল। রাফির মন থেকে এক পলকও শঙ্কা সরছিল না, কিন্তু তার শরীরের মধ্যে আগুনের তীব্রতা বাড়ছিল, যা তার আত্মবিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে তুলছিল।
"তুমি এখানে কী করতে এসেছ?" হঠাৎ একটি গম্ভীর কণ্ঠ তার কানে এলো। রাফি ঘুরে তাকাল। একটি শ্বেতশুভ্র ছায়ামূর্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখ ছিল ক্ষুধার্ত, যেন সে কিছু খুঁজছে।
"আমি... আমি জানি না," রাফি বলল, কিন্তু তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস ছিল। "আমি জানি না কেন, কিন্তু কিছু একটা আমাকে এখানে এনেছে।"
ছায়ামূর্তিটি একটু এগিয়ে আসল। "তুমি আগুনের ছেলে, তাই তো? তুমি মনে করো তুমি আগুনের নিয়ন্ত্রণ পাবে?"
রাফি সোজা দাঁড়িয়ে মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে বলল, "হ্যাঁ, আমি আগুনের ছেলেই। আমি জানি, আমি আগুনের নিয়ন্ত্রণ নেব।"
ছায়ামূর্তিটি এক ভিন্ন হাসি দিল, যেন সে তার কথা শুনে কিছু বুঝতে পেরেছে। "তাহলে দেখ, তোমার সামনে যা অপেক্ষা করছে তা সহজ হবে না। আগুন শুধু ধ্বংস করে না, এটি সৃষ্টি করতে পারে, তবে এর শক্তি তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।"
রাফি কিছুটা সময় নীরবে দাঁড়িয়ে রইল, তার মনে ভেসে উঠল মায়ের মৃত্যুর দৃশ্য, আগুনের অসীম ঝলক, আর সেই অদ্ভুত কণ্ঠ, যা তাকে এই পথে নিয়ে এসেছে। সে মনে মনে স্থির করল, তার মধ্যে থাকা আগুনকে সে এখনই নিজের হাতেই নিয়ন্ত্রণ করবে।
"আমি প্রস্তুত," রাফি দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
ছায়ামূর্তিটি তার দিকে এক অবজ্ঞা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। "তুমি জানো না তুমি কী চাইছো," সে বলল, "আগুন একদিন তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, কিংবা তুমি তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু সেটি কখনও সহজ হবে না।"
এরপর গুহার ভেতর থেকে এক তীব্র ঝোড়ো হাওয়া উঠতে লাগল। রাফি অনুভব করল, তার শরীরের মধ্যে আগুনের শক্তি এক নতুন রূপে জেগে উঠছে। যেন কিছু একটা পরিবর্তিত হতে চলেছে। তাকে নিজের সত্তা খুঁজে বের করতে হবে—সে যে আগুনের ছেলে, তার সমস্ত ক্ষমতা তার নিজস্ব হতে হবে, কোনো বাহ্যিক শক্তির থেকে নয়।
"তুমি জানো না তুমি কী শুরু করতে যাচ্ছো," ছায়ামূর্তিটি আবার বলল, এবং তারপর ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। রাফি এক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে রইল, যেন তার চারপাশের সমস্ত কিছু বদলে গেছে।
সে জানত, সামনে তাকে আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। আগুন তার ভিতরে প্রবাহিত হতে থাকুক, কিন্তু তাকে কেবল নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এই পথের শেষ কোথায়, সে জানে না, তবে আজকের পর থেকে তার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে।
“আমি আগুনের ছেলে, এবং আমি এই পৃথিবীকে বদলে ফেলব,” রাফি দৃঢ় কণ্ঠে নিজের উদ্দেশ্য ঘোষণা করল, আর নিজের পথ চলা শুরু করল।
অধ্যায় ৭: আগুনের মাঝে
রাফি গুহার ভেতর এক দীর্ঘ সময় কাটানোর পর বাইরে বের হয়ে এল। রাতের আকাশ এতটাই গা dark ়, যেন তার অস্তিত্বকে মুছে ফেলতে চাইছে। বাতাসে শীতলতা ছিল, তবে তার ভিতরে এক অদ্ভুত তাপ অনুভূত হচ্ছিল—অগ্নির তাপ, যা তাকে এক অবিনাশী শক্তি দিচ্ছিল। সে জানত, আজকের পর তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। আগুনের ছায়া তার সাথে থাকবে, তার সমস্ত অস্তিত্বের অঙ্গীকার হয়ে।
গুহা থেকে বেরিয়ে এসে সে সোজা শহরের দিকে চলতে লাগল। আজ আর কোনো ভীতি তার মধ্যে নেই। একসময় আগুনকে সে ভয় পেত, এখন সে আগুনের মধ্যে চলে এসেছে। আগুনের শক্তি তার ভেতরে প্রবাহিত হচ্ছে, আর সেই শক্তি তাকে পথ দেখাচ্ছে।
যতই সে শহরের কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, ততই তার মনে হচ্ছিল, সব কিছু যেন তার প্রতি চোখ রেখে আছে। শহরের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি রাস্তায়, যেন অদৃশ্য কোনো দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু এবার সে আর ভয় পেল না। তার মন বলছিল, এটা তার উদ্দেশ্যের পথ—তার যে দায়িত্ব, তার যে সংকল্প, সেই পথেই তাকে এগোতে হবে।
শহরের বাজার এলাকায় এসে পৌঁছাল রাফি। সেখানে কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছিল। তবে, তাদের মধ্যে কেউ তার দিকে লক্ষ্য করল না। তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা ছিল, যেন তারা জানে রাফি আগের মতো আর সাধারণ মানুষ নয়। রাফি একটু এগিয়ে গেল, কিন্তু তার চোখে কিছু অদ্ভুত কিছু ছায়া দেখছিল, যেন কিছু কিছু মানুষ তাকে খেয়াল করছে, কিন্তু মুখে কিছু না বলেই তা গ্রহণ করছে।
এতক্ষণে, রাফি টের পেল, আগুনের ছায়া তার থেকে আরও বেশি দূরত্ব তৈরি করতে চাচ্ছে। যেন, আগুন আর মানুষকে একত্রে থাকতে চায় না। তার মধ্যে কিছু একটা আছে—একধরনের শক্তি যা তাকে জানাচ্ছে, তাকে আবার এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ঠিক সেই মুহূর্তে, হঠাৎই তার কাছে এক অদ্ভুত কণ্ঠ আসল। "তুমি যা করতে চাও, তা শুধু তোমার ক্ষমতার মধ্যে নয়, বরং তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।"
রাফি তার চোখ বন্ধ করে, সেই কণ্ঠের দিকে মনোযোগ দিল। সে জানত, এটা আবার সেই অদ্ভুত শক্তির কণ্ঠ, যা তাকে বারবার প্রবৃত্তির দিকে ঠেলে দেয়। সে ধীরে ধীরে মাথা নীচু করে বলল, "আমি জানি, তবে আমি একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। আমি আগুনের ছেলে।"
কণ্ঠটি কিছুক্ষণ নীরব থাকল, তারপর আবার বলল, "তুমি যদি সত্যিই আগুনের নিয়ন্ত্রণ পেতে চাও, তবে তোমার পুরানো ভয়কে একেবারে মুছে ফেলতে হবে। আগুনের মধ্যে প্রবাহিত হওয়া মানে, নিজের সত্তাকে হারানো নয়, বরং নতুন করে নিজেকে সৃষ্টি করা।"
রাফি এক মুহূর্ত ভাবল। সত্যিই কি সে এতটা প্রস্তুত? আগুনের তীব্রতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলবে না তো?
কণ্ঠটি আবার ভেসে উঠল, "তুমি যদি প্রস্তুত হও, তবে তোমাকে সেই স্থান খুঁজে বের করতে হবে—যেখানে আগুনের শেষ সীমা রয়েছে, যেখানে তোমার হৃদয়ের সব সংকল্প পরীক্ষা হবে।"
রাফি চোখ খুলে, এক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে জানত, আগুন তাকে কেবল ধ্বংস করতে চায় না—এটা তাকে নতুন করে তৈরি করতে চায়। তাকে এখন সেই জায়গায় পৌঁছাতে হবে, যেখানে আগুন তার হৃদয়ের ভিতর প্রবাহিত হয়ে তাকে তার আসল শক্তি দেখাবে।
শহরের মাঝখানে চলে আসার পর, রাফি এক সময় নিজেকে স্থির রাখল। আজকের পর তার জীবনে কিছু আর আগের মতো থাকবে না। সে আগুনের ছেলে—এটাই তার পরিচয়, আর সে নিজে সেই আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
"এবার কিছু করবে," সে নিজে নিজে বলল। "যেখানে আগুনের শেষ সীমা, সেখানে আমাকে যেতে হবে। আমি জানি, এটা শুধু আমার যাত্রা নয়, এটা আমার পথ, আমার জীবনের লক্ষ্য।"
তারপর, রাফি পথ চলতে শুরু করল। আগুন তার সাথে ছিল—এখন থেকে, তাকে আর কোনো কিছু থামাতে পারবে না।
অধ্যায় ৮: আগুনের পথ
রাফি এক অদ্ভুত স্থিরতার মধ্যে চলতে চলতে শহরের প্রান্তে পৌঁছাল। বাতাসের মধ্যে ছিল এক অজানা গন্ধ, যেন কোনো পুরানো রহস্য উন্মোচিত হতে চলেছে। তার মন ভারি হয়ে উঠছিল, কারণ সে জানত—এবার তাকে এমন এক জায়গায় পৌঁছাতে হবে, যেখানে আগুন তার সমস্ত ভয়কে নিশ্চিহ্ন করে নতুন করে জন্ম নেবে।
যতই সে শহরের বাইরে এগিয়ে যাচ্ছিল, ততই আশেপাশের পরিবেশ আরো অদ্ভুত হতে থাকল। রাস্তার পাশে ঝাঁকুনির মতো কিছু দেখা যাচ্ছিল—একটা ছায়া, যা মনে হচ্ছিল তার পিছু পিছু চলে আসছে। রাফি থামল, তারপর পিছনে তাকিয়ে দেখল, কিন্তু কিছুই ছিল না। সে আবার চলতে শুরু করল, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাকে আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছিল, এক অদৃশ্য গর্তের দিকে, যেখানে আগুন তাকে অপেক্ষা করছে।
তার সামনে একটি পাহাড়ের পাদদেশ দেখা দিল। পাহাড়টা ছিল বিশাল, যেন পৃথিবী আর আকাশের মাঝখানে কোনো বিভেদ রেখেছে। পাহাড়ের চূড়া থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল, যা রাফির ভেতরের আগুনকে যেন আরও তীব্র করে তুলছিল। তার মধ্যে এক অদ্ভুত টান অনুভূত হচ্ছিল, যা তাকে সেই পাহাড়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
“এই জায়গায় কিছু আছে,” রাফি মনে মনে বলল। “এটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছানোর পর, রাফি তার আশপাশে এক ঝলক দেখল। সেখানে ছিল এক পুরানো মন্দির, যার দেয়ালে আগুনের ছবি খোদিত ছিল। মন্দিরের ভেতরে যেতে কিছুটা ভয় লাগছিল, কিন্তু তার মন বলছিল—এখানেই তার উত্তর অপেক্ষা করছে।
সে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেল। ভেতরে প্রবেশ করার পর, অন্ধকারে তার চোখ কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, তবে অনুভব করতে পারছিল, এখানে কোনো শক্তি রয়েছে। এক পুরানো আড়ালে, মন্দিরের মধ্যে স্ফটিকের একটি পাথর দেখতে পেল, যা লাল আভায় জ্বলছিল। পাথরের ওপর শীল্পিত ছিল কিছু প্রাচীন অক্ষর, যেগুলো রাফি ঠিকমতো বুঝতে পারছিল না, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, এই অক্ষরগুলোর মধ্যেই তার কাঙ্ক্ষিত রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।
তার সামনে একটি গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল, "তুমি এখানে কেন এসেছো?"
রাফি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, "আমি জানি, এই আগুনের শেকড় এখানে কোথাও রয়েছে। আমি জানতে চাই, আমি আগুনের ছেলে, কেন আমাকে এই পথ নিতে হবে?"
অন্ধকার থেকে একটি ছায়া বেরিয়ে এল। একটি পুরানো পুরোহিত, যার চোখে গভীর দৃষ্টি ছিল, সে তার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি সত্যিই জানো কি চাও, আগুনের ছেলে?"
রাফি এক মিনিটের জন্য থমকে গেল, তারপর দৃঢ়ভাবে বলল, "আমি জানি। আমি আগুনের শক্তি গ্রহণ করতে চাই, যাতে আমি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।"
পুরোহিত কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলল, "তুমি যদি আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাও, তবে প্রথমে তোমাকে তোমার নিজের ভীতিকে জয় করতে হবে। আগুন বাহ্যিক নয়, এটা তোমার ভেতরে লুকিয়ে আছে। একবার তুমি যদি নিজের ভিতরের আগুনকে চেনো, তখন তুমি যে কোনো শক্তি জয় করতে পারবে।"
রাফি একটু অবাক হয়ে পুরোহিতের দিকে তাকাল। সে কখনো ভাবেনি যে, আগুন তার বাহ্যিক শক্তির মতো নয়, বরং এটি তার ভেতরের শক্তি হতে পারে। তার মনের মধ্যে এক ঝড় শুরু হল—এটা আসলেই সত্যি? তার ভিতরের আগুনই কি তাকে শক্তিশালী করবে?
পুরোহিত আবার বলল, "এই মন্দির একসময় ছিল এক শক্তিশালী সত্তার আশ্রয়স্থল। আগুন ছিল তার আত্মা, আর এই পাথরের মধ্যে সেই আগুনের চিহ্ন রয়েছে। তুমি যদি এই চিহ্নের মর্ম বুঝে ফেলো, তবে তুমি আগুনের আসল শক্তি ধারণ করতে পারবে।"
রাফি পাথরের দিকে তাকাল, আর ধীরে ধীরে সে আঙুল দিয়ে অক্ষরগুলো স্পর্শ করতে শুরু করল। সেই মুহূর্তে, তার শরীরে আগুনের তীব্রতা অনুভূত হতে লাগল। পাথরটি যেন তাকে নিজের মধ্যে শোষণ করছিল, আর রাফি অনুভব করল তার ভেতরে এক অগ্নিদেবতা প্রবাহিত হচ্ছে, যা তাকে তার শক্তি সম্পর্কে বুঝিয়ে দিচ্ছিল।
তবে, ঠিক সেই সময়, মন্দিরের দেয়ালগুলো আচমকা কেঁপে উঠল। রাফি অনুভব করল, তার সামনে আরো অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এই পথ সহজ নয়, তাকে নিজের ভিতরের শক্তি সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে হবে, আর আগুনের শক্তি তাকে ছিনিয়ে নিতে চাইবে।
"এখন তুমি প্রস্তুত?" পুরোহিতের কণ্ঠ আবার শোনা গেল, "এটাই তোমার শেষ পরীক্ষা।"
রাফি নিজেকে প্রস্তুত করল। তার ভিতরের আগুন ইতিমধ্যে জ্বলতে শুরু করেছে, এবং সে জানত, এই আগুনই তাকে জয়ী করবে—এখন তাকে তার ভিতরের শক্তিকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
তারপরে, মন্দিরের মধ্যে এক তীব্র আগুনের শিখা দেখা দিল। রাফি জানত, এই আগুন তার জন্য আসল পরীক্ষা।
চলবে....
Post a Comment