Infernal Boy (একটি ধারাবাহিক গল্প)


আগুনের ছেলে (একটি ধারাবাহিক গল্প)


অধ্যায় ১: অচেনা আগমন

ধারাপাড়া গ্রামের পাশেই ছিল এক পুরনো অনাথাশ্রম। নাম—শান্তির নীড়। সাদা রঙের রঙচটা দেওয়াল, ছাদের ফাটল দিয়ে ঝুলে থাকা মরচে পড়া পাখা আর সবসময় এক অদ্ভুত গন্ধে ভরা ঘরগুলো যেন নিজেই বলছিল, এখানে কিছু একটা ঠিক নেই।

একদিন সকালে, হঠাৎ এক লোক এসে এক ছেলেকে রেখে গেল। ছেলেটার বয়স বড়জোর দশ। নাম—ঋত্বিক। পরনে ময়লা জামা, মুখে একফোঁটা হাসি নেই। চোখদুটো কালো, অস্বাভাবিক গভীর। যেন কেউ গহীন গহ্বরের দিকে তাকিয়ে আছে।

ঋত্বিক প্রথম এক সপ্তাহ একটাও কথা বলেনি। শুধু তাকিয়ে থাকত—কখনও জানালার বাইরে, কখনও ছাদের দিকে, কখনওবা সরাসরি অন্য কারো চোখে। বাকিদের ভেতর অস্বস্তি তৈরি হচ্ছিল।

তার আগমনের পরেই শুরু হলো অদ্ভুত ঘটনা। আশ্রমের কুকুরগুলো হঠাৎ করেই চুপ করে গেল, এমনকি খাওয়ার সময়ও আর ঘেউ ঘেউ করত না। চারদিকের কাকগুলো কেমন যেন গোল হয়ে ছাদের ওপর ঘুরে বেড়াত—কিন্তু একটাও আওয়াজ করত না।

এরপর একদিন মাঝরাতে, আশ্রমের পশ্চিম দিকের ঘর থেকে আগুন লেগে যায়। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো—কোনো শব্দ হয়নি। আগুন জ্বলছিল, কিন্তু কাঁঠাল কাঠের পোড়ার আওয়াজ ছিল না। কেউ চিৎকার করেনি। সবাই ঘুমিয়ে ছিল, শুধু একমাত্র ঋত্বিক দাঁড়িয়ে ছিল আগুনের মাঝখানে। চোখ দুটো লালচে, আর মুখে এক অদ্ভুত হাসি।

ঘটনার পরদিন থেকে আশ্রমের বাচ্চারা ভয় পাচ্ছিল ঘুমোতে। তারা সবাই একই রকম স্বপ্ন দেখছিল—এক পুড়ে যাওয়া ছেলের ছায়া, দাঁড়িয়ে আছে বিছানার পাশে। তার কণ্ঠস্বর ভয়ংকর, যেন অনেকগুলো কণ্ঠ একসাথে বলছে:
"চলো খেলি… চিরদিনের জন্য…"

কিছু বাচ্চা জেগে উঠেই চিৎকার করত, আবার কিছুদিন পর হঠাৎ উধাও হয়ে যেত—শুধু বিছানায় থাকত কালো ছাইয়ের দাগ।

সিস্টার আগ্নেস, যিনি আশ্রম চালাতেন, তিনি বুঝলেন এ ছেলে সাধারণ নয়। তিনি তাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রতিবার কোনো গাড়ি বা লোক এলেই দুর্ঘটনা ঘটত। কেউ অন্ধকারে কিছু দেখতে পেত না, কেউ আবার রহস্যজনকভাবে আহত হয়ে ফিরে যেত।

এক রাতে, সিস্টার আগ্নেস পুরনো লাইব্রেরির নিচে একটা ধুলো জমা বেদির তলায় একটা পুরনো ডায়েরি খুঁজে পান। সেটা ছিল আগের তত্ত্বাবধায়কের লেখা, যে বছর দশেক আগে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায়।

ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল—
"এক সময় এক মা তার ছেলেকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। কারণ সে জন্ম থেকেই অভিশপ্ত। সে বলেছিল, ছেলে আবার ফিরে আসবে, আর তখন সে শিশুদের খেলতে ডাকবে—তবে সেই খেলা আর ফুরোবে না…"

সিস্টার আগ্নেস বুঝলেন—ঋত্বিক সেই ছেলেই, অগ্নিপুত্র
এক infernal আত্মা—এক ভয়ংকর অভিশাপ।


অধ্যায় ২: ভয়ংকর সত্য

সিস্টার আগ্নেসের চোখের সামনে পুরনো ডায়েরি পড়ে ছিল, আর তার মাথায় যেন সমস্ত সময়ের ভয়াবহতা ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিচ্ছিল। তিনি জানতেন, এই রহস্যের গভীরে যা কিছু আছে, তা একেবারেই সাধারণ নয়। কিন্তু কীভাবে তার মোকাবিলা করবেন? এই প্রশ্নটা তার মনে ঘুরছিল, যখনই তিনি ঋত্বিকের দিকে তাকাতেন। ছেলেটার সুরাহা নেই, যেন অন্ধকারের কিছু একটা ভীষণভাবে তাকে বেঁধে রেখেছে।

এক সপ্তাহ পর, সিস্টার আগ্নেস আর কোনো উপায় না পেয়ে আশ্রমের পুরনো ধর্মীয় গ্রন্থের সাহায্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সন্ধ্যা হয়ে আসার আগেই, এক চুপচাপ সন্ধ্যায়, এক নিকটবর্তী গির্জার পুরোহিতকে ফোন করেন।

"আপনি যদি সত্যিই সাহায্য চান, তবে আপনাকে জানাতে হবে এই ছেলেটি সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। তার দিকে না তাকানোই শ্রেয়। আর সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়—সে পুড়ে মরে না, সে জ্বলে যায়!" পুরোহিতের কণ্ঠে ভীতি ছিল।

এই কথাগুলো শুনে, সিস্টার আগ্নেস জানতেন, আর কোনো সময় নষ্ট করা চলবে না। তবুও, ঋত্বিক তার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল। তার চোখের মধ্যে যে অগ্নি জ্বলছিল, সেটা এখন কেবল হিংস্র হয়ে উঠেছিল। কেউ দেখলে মনে হতো, সে কোনো মানব নয়—সে যেন কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির বাহক।

বিকেল বেলায়, সিস্টার আগ্নেস সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নিজেই ঋত্বিকের সঙ্গে মুখোমুখি হবেন। তিনি আশ্রমের এক কোণে গিয়েছিলেন, যেখানে ঋত্বিক গাছের ছায়ায় বসে ছিল, তার কালো চোখদুটো যেন গভীর অন্ধকারের মতো। এক মুহূর্তের জন্য সিস্টার আগ্নেস থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

"ঋত্বিক, তুমি কি জানো যে তুমি কে?" সিস্টার আগ্নেস নরমভাবে প্রশ্ন করলেন।

ঋত্বিক তার চোখের পলকে সিস্টার আগ্নেসের দিকে তাকাল। সেই মুহূর্তে তার মুখে একটি হালকা হাসি ফুটে উঠল, যা সিস্টার আগ্নেসের শরীরের রক্ত জমিয়ে দিল। তার চোখ দুটো যেন আগুনের শিখায় পরিণত হয়েছিল।

"আমি সেই যে ফিরে আসব... যারা হারিয়ে গেছে তাদের... তোমাদের… আমি তোমাদের আবার আমার কাছে চাই।" ঋত্বিকের কণ্ঠে একটি ভয়ংকর বিষণ্ণতা ছিল, আর তার শব্দগুলো যেন সবার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, দুঃস্বপ্নের মতো।

এখন সিস্টার আগ্নেস পুরোপুরি বুঝতে পারলেন যে, ঋত্বিককে শুধু পাঠানো যাবে না, তাকে শেষ করতে হবে। কিন্তু কিভাবে?

রাতের আঁধারে সিস্টার আগ্নেস প্রাচীন এক ধর্মগ্রন্থের পৃষ্ঠাগুলো উল্টাচ্ছিলেন, তাতে লেখা ছিল—"শুধু শুদ্ধ আত্মাই এই দানবীয় শক্তিকে পরাস্ত করতে পারে।" তখনই তিনি বুঝলেন, যে শক্তি ঋত্বিককে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটা এই পৃথিবীর নয়, সে এক অতীন্দ্রীয় শক্তি।

তবে, এক্ষুণি আর সময় নেই। সে শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, কিছু করতে হলে, এক ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিতে হবে—ঋত্বিককে আশ্রমে থাকতে দেওয়া যাবে না, তাকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

এবং ঠিক তখনই, ঘরটি পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে গেল।

এক মুহূর্তের মধ্যে, সিস্টার আগ্নেসের সামনে সবকিছু যেন ঘুরতে শুরু করল। হঠাৎ অন্ধকার থেকে, ঋত্বিক এক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে এসে বলল, "আমার সঙ্গে খেলো… চিরকাল, সিস্টার… খেলার সময় শেষ হয়ে আসছে…"

সিস্টার আগ্নেস পেছনে ফিরলেন, তার হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরা ছিল সেই ধর্মগ্রন্থ। তিনি জানতেন, এই যুদ্ধে তাকে একাকী লড়তে হবে। এখন তাকে দাঁড়াতে হবে, অথবা হারিয়ে যেতে হবে।


অধ্যায় ৩: শেষের শুরু

অন্ধকার রাত, আশ্রমের চত্বরে এক সন্নিকটে থমথমে নিরবতা। সিস্টার আগ্নেস যখন ফিরছিলেন, তখন ঋত্বিকের মুখের সেই ভয়ঙ্কর হাসি তার চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ভেসে উঠছিল। সে কি সত্যিই অভিশপ্ত? তার পেছনে এক অতিপ্রাকৃত শক্তি আছে—এটা কি এক মিথ, না এক অমোচনীয় সত্য?

তিনি জানতেন, শুধু প্রার্থনা ও ধর্মীয় বইয়ের মাধ্যমে ঋত্বিককে ঠেকানো যাবে না। এক পবিত্র শক্তির প্রয়োগ দরকার, যা তাকে এই পৃথিবী থেকে পুরোপুরি মুছে দিতে পারে। সিস্টার আগ্নেস চেয়েছিলেন পুরোহিতের সাহায্য, তবে তিনি একা লড়তে জানতেন, অন্য কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তবুও, একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা ছাড়েননি তিনি।

রাত ১২টা বাজতেই, সিস্টার আগ্নেস গির্জার পাদ্রি প্যারিসিলোর সাথে মিলিত হলেন। গির্জার ভেতরে ঢোকার সময় বাতি নিভে গিয়েছিল এবং কুয়াশার মধ্যে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে উঠছিল। অদ্ভুত কিছু অনুভূতি সিস্টার আগ্নেসের মনকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। গির্জার ভেতর, প্যারিসিলো কিছু বলছিল, তবে তার কণ্ঠ যেন তার নিজের মতো করে বিকৃত হয়ে যাচ্ছিল।

"এটা একটা দুঃস্বপ্ন," প্যারিসিলো বললেন। "ঋত্বিক সত্যিই ওই আগুনের ছেলেটি। যদি তুমি তাকে সঠিকভাবে নিষ্কৃত না করতে পারো, তবে তার পেছনে থাকা শক্তি এই পুরো অঞ্চলকে গ্রাস করবে।"

সিস্টার আগ্নেস শ্বাস নিচ্ছিলেন গভীরভাবে, চোখে একরাশ আতঙ্ক। "তাহলে কী করতে হবে আমাদের?"

প্যারিসিলো তার চোখ তুলে, দৃঢ়ভাবে বললেন, "তোমাকে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে, শুধুমাত্র তখনই তোমরা শেষ করতে পারবে তার কুফল।"

অথচ সিস্টার আগ্নেস জানতেন, এই চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া সহজ নয়। তিনি ঋত্বিকের অভিশাপের সম্বন্ধে আরও জানার চেষ্টা করলেন এবং এক পুরনো গ্রন্থ থেকে বের করা একটি অশুভ রসায়ন পড়লেন, যা ছিল এক ধরনের সুনির্দিষ্ট আচার-ধর্ম। এই আচার শুধু তন্ত্র মন্ত্রের বিষয় ছিল না, এটি ছিল একটি অত্যন্ত শক্তিশালী আত্মিক যুদ্ধ—যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত একেবারে মহামূলক হতে পারত।

সে রাতে, সিস্টার আগ্নেস প্রস্তুতি নিলেন। তিনি একা এক পাহাড়ের চূড়ায় গিয়েছিলেন, যেখানে পুরনো এক প্রার্থনার মন্দির ছিল। তাঁর হাতে ছিল সেই ধর্মীয় বই, কিছু মন্ত্র, এবং একটি দেহবিহীন প্যাঁচানো তার। সিস্টার আগ্নেস জানতেন, ঋত্বিকের শক্তি কোথাও বন্ধ থাকা শক্তি, যা তাকে পূর্ণ করতে হবে।

কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন সিস্টার আগ্নেস সেই ভয়ানক মন্ত্র পাঠ করছিলেন, তাঁর সামনে ঋত্বিক উপস্থিত হলো—চিরন্তন আগুনের ছায়া, তার চোখে দাহ্য লাল। মুখে সেই একই হাসি।

"তুমি কি ভাবছ, সিস্টার?" ঋত্বিক তার কণ্ঠে খুশি এক ঝংকার নিয়ে বলল, "এই পৃথিবী আমাকে চেনে, কিন্তু তুমি আমাকে বুঝতে পারবে না।"
তার পেছনে, একটি গভীর গর্জন শোনা গেল, যেন কিছু অদৃশ্য শক্তি তাদের দিকে ধেয়ে আসছে।

ঋত্বিক দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল। সিস্টার আগ্নেস জানতেন, এই মুহূর্তে তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু তার সামনে সে দাঁড়িয়ে ছিল, এক ভয়ংকর শক্তি, যা একেবারে অগ্নিতে পরিণত হচ্ছিল। সিস্টার আগ্নেস চিৎকার করে তার মন্ত্রটি উচ্চারণ করতে শুরু করলেন, “ভয় পাও না, শক্তি ভয়ঙ্কর নয়, আমি তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছি…”

ঋত্বিক হেসে উঠল। "তুমি কী বুঝছ, সিস্টার? তুমি তো জানো না আমি কী! আমি তোমাদের সর্বশেষ স্মৃতি, তোমাদের ভয়, তোমাদের অন্ধকার। আমি আগুন। আমি মৃত্যু।"

অর্ধেক ঘর পুরোপুরি পুড়ে গেল। সিস্টার আগ্নেসের চোখ ঝলসে উঠল। তবুও, তিনি তার চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রেখেছিলেন—এটা ছিল জীবনের শেষ যুদ্ধ।


অধ্যায় ৪: আগুনের পরীক্ষা

সিস্টার আগ্নেসের মুখে দুঃসাহসী মন্ত্র উচ্চারণ হচ্ছিল, কিন্তু তার ভিতরে এক অদ্ভুত দোলা অনুভূত হচ্ছিল। ঋত্বিক তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, তার অগ্নিশিখা চোখে জ্বলছিল। তার শক্তি এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে, গির্জার পুরনো পাথরও সিগ্ধ হয়ে গলতে শুরু করেছিল। বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ ভেসে আসছিল—এটা মৃত্যু ছিল, নাকি কিছু আরো ভয়ংকর?

ঋত্বিক তার ঠোঁটের কোণে এক মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, "তুমি ভাবছ, এই পুরনো বই আর মন্ত্র দিয়ে আমাকে হারাতে পারবে? তোমরা তোমাদের ধর্মের শক্তি ব্যবহার করেছো—কিন্তু আমি জানি, আমি কে। আমার মধ্যে এক আগুন আছে, যা তোমাদের চিন্তার বাইরে। আমি অমর। আমি ফিরেছি, তোমরা আমাকে বন্ধ করতে পারবে না।"

সিস্টার আগ্নেস, যদিও তার ভয় অনেক বেড়ে গিয়েছিল, তবুও তার মধ্যে একটা দৃঢ় সংকল্প তৈরি হয়েছিল। তাকে এই যুদ্ধ জিততেই হবে। যদি না, তবে এই পৃথিবী আর শান্তি পাবে না। সেই পুরনো গ্রন্থে লেখা ছিল যে, শুধুমাত্র আত্মিক শক্তি দিয়ে যদি সত্যিকারের মন্দ শক্তি পরাজিত করা যায়, তবে সেই শক্তি চিরতরে নিষ্ক্রিয় হবে। কিন্তু এই যুদ্ধ ছিল ভয়ানক—ঋত্বিক আর তার পেছনের অন্ধকার শক্তি এমনকি তাকে নিঃশেষ করতে পারত।

"আমি তোমাকে পরাজিত করব, ঋত্বিক," সিস্টার আগ্নেস দৃঢ় কণ্ঠে বললেন। "এই পৃথিবী তোমার নয়। তুমি এখনো শিশুর রূপে আছ, কিন্তু তুমি জানো না—তোমার শক্তি কেবল তোমার একাগ্রতা আর অন্ধকারে জন্ম নেয়। আমি তোমাকে জানিয়ে দেব, তুমি যে আসলে কেবল একটি অভিশপ্ত আত্মা, তাতে কিছুই পরিবর্তন হয় না।"

ঋত্বিক হেসে উঠল, তার হাসি যেন কয়েকটি ভিন্ন কণ্ঠ থেকে বের হচ্ছিল। "তুমি ভুল বুঝছ, সিস্টার। আমি তোমাদের আশ্রয়ে পলায়ন করতে এসেছি, আমি আমার খেলনা খুঁজে পেয়েছি—এবং এখন তোমার পালা।"

তারপর, আচমকা, ঋত্বিক একটানা কাঁপতে শুরু করল, আর তার শরীর থেকে আগুনের শিখা বের হতে লাগল। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়তে লাগল, চারপাশের বাতাস উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সিস্টার আগ্নেস প্রার্থনা করতে শুরু করলেন, আর চোখে-মুখে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ল। এই আগুন আর অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা এত সহজ ছিল না। তার মনে হচ্ছিল যেন কোন শেষ নেই। তার পাথরের মতো শক্ত মনে হচ্ছিল—আর কিছু না, শুধু এই পৃথিবীকে ঋত্বিকের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে হবে।

তবুও, সিস্টার আগ্নেসের মধ্যে এক অনুপ্রেরণা জেগে উঠল—এক শক্তি, যা তার নিজের ভেতরই লুকিয়ে ছিল। তা ঠিক তখনি, এক মুহূর্তের জন্য, সিস্টার আগ্নেসের হাত থেকে এক সাদা আলো বের হয়ে এল। সেই আলো ছিল সেই পবিত্র শক্তি, যা তিনি বছরের পর বছর ধরে অঙ্কিত করেছিলেন। এই আলো ঋত্বিকের আগুনের বিরুদ্ধে একমাত্র অস্ত্র ছিল।

ঋত্বিক তা দেখতে পেল। তার চোখে ঘৃণার উত্তেজনা ফুটে উঠল, কিন্তু তার চোখের মধ্যেও ভয় ছিল—এটা ছিল তার বিপর্যয়ের লক্ষণ।

সিস্টার আগ্নেস হাত ছড়িয়ে আলোকে ঋত্বিকের দিকে পাঠালেন, আর সেই সাদা আলো ঋত্বিকের উপর আছড়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে, চারপাশে গর্জন শোনা গেল, আর অদ্ভুতভাবে আগুন কমে আসতে লাগল। ঋত্বিক চিৎকার করে উঠল, তার শরীর থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে লাগল।

এটা ছিল সিস্টার আগ্নেসের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। সেই ভয়ংকর শিশুর মুখে পরিবর্তন আসছিল। তার পেছনে যা কিছু ছিল, তা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে সম্পূর্ণ হারেনি। তার ভেতর ছিল কিছু অন্ধকার শক্তি, যা আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে—এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কে জিতবে, তা স্পষ্ট হয়নি।

সিস্টার আগ্নেস জানতেন, এই লড়াই কেবল শুরু হয়েছে।


অধ্যায় ৫: অন্ধকারের অন্তরালে

সিস্টার আগ্নেস অবাক হয়ে দেখলেন, ঋত্বিকের শরীর থেকে আগুন এবং কালো ধোঁয়া কিছুটা কমে গেছে, তবে তার চোখের মধ্যে এক অদ্ভুত দ্যুতি ছিল। যেন সে কোনোভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সিস্টার আগ্নেসের শরীর থেকে বের হওয়া সাদা আলো এখনো ভাসছিল, কিন্তু এটা সবার চোখে পড়ছে না। তার নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাঁপছিল—সে জানত, সে এখনো শেষ করেনি। এই লড়াইয়ের মাত্র এক মুহূর্তের জয়, কিন্তু যুদ্ধে পুরোপুরি জয় পাওয়া এখনও বাকি।

ঋত্বিক তার দিক থেকে এক পা এগিয়ে এল, তার চোখে সেই আগুনের শিখা। "তুমি আমাকে শেষ করতে পারবে না, সিস্টার। আমি কোনো সাধারণ ছেলে নই। আমি... আমি সেই শক্তি, যে অগ্নি পৃথিবীর সবকিছু পুড়িয়ে ফেলতে পারে। তুমি কী ভাবছ, তোমার পবিত্রতা আমাকে পরাজিত করবে? এই অগ্নি কখনো নিভবে না।"

ঋত্বিকের কণ্ঠে আবার সেই ভয়ঙ্কর সুর ছিল, যা সিস্টার আগ্নেসের অন্তরকে শিহরিত করছিল। সে এক অভিশপ্ত আত্মা, যে ফিরেছে আর পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য। তার চোখের গভীরে গভীর অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছিল। যে শক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল, তা যেন আরও গভীর ছিল। সিস্টার আগ্নেস অনুভব করতে পারছিল, এই লড়াইয়ের পরিণতি আসলেই ভয়াবহ হতে পারে।

সিস্টার আগ্নেস আর একবার সান্ত্বনার জন্য প্রার্থনা করতে শুরু করলেন। মন্ত্র উচ্চারণের সময়, তার শরীরের চারপাশে সাদা আলো ঘুরতে লাগল, কিন্তু এবার ঋত্বিক কোনো ভয় দেখাচ্ছিল না। সে এক কদম এগিয়ে আসতে থাকল।

"তুমি পারবে না," ঋত্বিক আবার বলল, "এটাই তোমার শেষ যাত্রা।"

এক মুহূর্তের জন্য, সিস্টার আগ্নেসের মন মাঝে মাঝে দূর হয়ে যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, তার সামনে একটি দৃশ্য ভেসে উঠল—ঋত্বিকের আগুনের মাঝে, এক কালো ছায়ার উপস্থিতি।

ঋত্বিক আসলে এক ছায়ামূর্তি ছিল—এক ভয়াবহ আত্মা, যে হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পাপের মধ্যে বাস করেছে। তার আগুন তার নিজের সত্তার একটি অংশ। সে মনের গভীরে প্রবাহিত শক্তির স্রোত, যা আসলে এক তান্ত্রিক অভিশাপের অংশ। সিস্টার আগ্নেস উপলব্ধি করলেন, এই ছেলেটি তার অগ্নিরূপ নয়, সে তার অন্ধকারের মনস্কীর্ণ ক্ষমতার বাহক—এক দানব, এক অবিশ্বাস্য শক্তি।

সিস্টার আগ্নেস এক মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়ে গেলেন, কিন্তু ঠিক তখনই তার মধ্যে আবার সেই পবিত্র শক্তি জাগ্রত হলো। সে জানত, এই যুদ্ধ তাকে লড়তেই হবে—নিজের শক্তি ও ঈশ্বরের সাহায্য নিয়ে।

"ঋত্বিক," সিস্টার আগ্নেসের কণ্ঠে এবার দৃঢ়তা ছিল, "তুমি জানো না, তোমার ভিতরে কি শক্তি আছে। তুমি তোমার নিজেকে ভুল বুঝছ। আমি জানি তোমার ভেতরে এক মানবতা রয়েছে—তুমি কেবল সেই পথ ভুলে গেছ। আমি তোমাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারব।"

ঋত্বিক থমকে দাঁড়িয়ে, এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার মুখে। তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য ঘর ঘুরল, যেন কোনো দ্বিধা ছিল। তবে সেটা ছিল সাময়িক—কিছুতেই সে ফিরে যাবে না। সে এখন এক অভিশপ্ত আত্মা, যার মধ্যে এক অশুভ শক্তি আছে যা তাকে অন্ধকারের পথে নিয়ে গেছে।

সিস্টার আগ্নেস আরও শক্তভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করলেন, তার হাতটা সরিয়ে নিলেন। এবার, এক অসীম আলো তার হাত থেকে বের হয়ে ঋত্বিকের দিকে আগমন করতে লাগল। সেই আলো যে কোনো অন্ধকারের শক্তিকে পরাস্ত করতে পারবে, সিস্টার আগ্নেস জানতেন। তার শক্তি ঈশ্বরের তরফ থেকে আসে, আর কোনো এক বিপর্যয়ের মধ্যেও সে তার আশ্রয় পাবে।

ঋত্বিক চোখে এক দুঃস্বপ্নের দ্যুতি নিয়ে দেখল। তারপর, এক শক্তিশালী গর্জন হল। এই যুদ্ধ শেষ হতে যাচ্ছে, কিন্তু কে জিতবে?


চলবে…

Post a Comment

Previous Post Next Post